রবিবার, ২৯ Jun ২০২৫, ০৫:২৪ অপরাহ্ন
ভয়েস নিউজ ডেস্ক:
জ্বালানি তেল আর ডলারের রেকর্ড দরকে পুঁজি করে বেড়েই চলেছে চালের দাম। সারাদেশের মতো চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় চালের মোকাম চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ ও পাহাড়তলীর চালপট্টিতেও নানা ছুতায় কারসাজির মাধ্যমে দাম বাড়ানো হচ্ছে দফায় দফায়। গরিবের ভরসা মোটা চালের দামও ৫০ কেজির প্রতিবস্তায় বেড়ে গেছে প্রায় ৫০০ টাকা। এমন দাম দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। প্রতিকেজি মোটা চাল কিনতেই এখন বাড়তি গুনতে হচ্ছে অন্তত ১০ টাকা। এ ছাড়া সব রকম চালের দাম প্রতিবস্তায় বেড়েছে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত। সুগন্ধিযুক্ত চিনিগুঁড়া চালের দাম মানভেদে রেকর্ড ৮০০ থেকে এক হাজার টাকা বেড়েছে।
তবে চালের দামের পালে হাওয়া বইতে থাকলেও প্রশাসন যেন কুম্ভকর্ণ। বাজার তদারকি না থাকার সুযোগ কাজে লাগিয়ে চালের দাম বাড়িয়েই যাচ্ছে অসাধু চক্র। কারসাজির সঙ্গে জড়িত উত্তরবঙ্গের কিছু বড় মিল মালিক, মধ্যস্বত্বভোগী ও বিভিন্ন করপোরেট গ্রুপ। চট্টগ্রামের ১৫ থেকে ২০ বড় ব্যবসায়ী-আড়তদারও তাঁদের সঙ্গে মিলিয়েছে হাত। যাদের কাছে রয়েছে প্রচুর চাল মজুত। মৌচাকে ঢিল ছোড়া গেলে আসল রহস্য বেরিয়ে আসত বলে মনে করছেন সংশ্নিষ্টরা।
ব্যবসায়ীসহ সংশ্নিষ্টদের দাবি, অসাধু চক্র নিজেদের মোকামে বাড়তি চাল মজুত রেখে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করছে। কিছু করপোরেট গ্রুপ বাড়তি লাভের আশায় অকেজো অনেক মিল নিজেদের হেফাজতে নিয়েছে।
আর সেখানেই চাল নিয়ে কারসাজি ও প্যাকেটজাতের কাজটি করছে তারা। ছোট-বড় নানা আকারে চাল প্যাকেটজাত করার কারণে সামগ্রিক বাজারে নেতিবাচক প্রভাবও পড়ছে। চট্টগ্রামের চালের বাজার পুরোপুরি নির্ভর উত্তরবঙ্গের ওপর। সেখান থেকেই চাল আসে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ ও পাহাড়তলী চালপট্টিতে। বড় এই তিন মোকাম থেকে মহানগরের পাশাপাশি চট্টগ্রামের ১৫ উপজেলা ও আশপাশের জেলায় চাল সরবরাহ করা হয়।
কিছুদিন আগেও চালপট্টিতে মোটা সিদ্ধ চালের বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) দাম ছিল ২১০০ থেকে ২২০০ টাকা। একই চাল এখন বিক্রি হচ্ছে ২৭০০ থেকে ২৭৫০ টাকায়। মাসখানেক আগেও একই মানের চাল প্রতিবস্তা ছিল ১৯০০ থেকে দুই হাজার টাকা। আগে খেটেখাওয়া মানুষ এক কেজি চাল ৪৩ থেকে ৪৫ টাকায় কিনতে পারলেও এখন পড়ছে ৫২ থেকে ৫৫ টাকা। এ ছাড়া মিনিকেট সিদ্ধ বস্তায় ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৮৫০ টাকা। জিরাশাইল সিদ্ধ চালের দাম বস্তায় ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ৩ হাজার ৬০০ টাকা। প্রতিবস্তা পাইজাম সিদ্ধ প্রায় ৪০০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকা, নাজিরশাইল সিদ্ধ ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৮৫০ থেকে ৯০০ টাকা, কাটারিভোগ সিদ্ধ ৪৫০ টাকা বেড়ে ৩ হাজার ৮০০ থেকে ৯০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতিবস্তায় ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা বেড়ে স্বর্ণা সিদ্ধ ২ হাজার ৬৫০ থেকে ৮০০ টাকা, কাটারিভোগ ৩ হাজার ৯০০ টাকা, মিনিকেট আতপ ২ হাজার ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা, পাইজাম আতপ ২ হাজার ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা, বেতি আতপ ২ হাজার ৫৫০ থেকে ৬৫০ টাকা, প্রতিবস্তায় সর্বোচ্চ ৮০০ থেকে একহাজার টাকা বেড়ে চিনিগুঁড়া চাল বিক্রি হচ্ছে মানভেদে ৫ হাজার ৯০০ থেকে ৬ হাজার টাকা।
এ ব্যাপারে পাহাড়তলী চাল ব্যবসায়ী বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দীন বলেন, ‘জ্বালানি তেল ও ডলারের দর বাড়ার কারণে প্রতিবস্তায় চালের দাম সর্বোচ্চ ৩০ থেকে ৫০ টাকা দাম বাড়ার কথা। সেখানে মোটা চালের দামই বেড়েছে বস্তায় প্রায় ৫০০ টাকা। অন্য চালের দামও বস্তাপ্রতি বেড়েছে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। এটি কারসাজি ছাড়া কিছুই নয়।’ ৪৫ বছরের ব্যবসাজীবনে এবারই প্রথম চালের এমন বাড়তি দর দেখছেন উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘বস্তায় প্রায় এক হাজার টাকার মতো বেড়েছে চিনিগুঁড়া চাল। বিভিন্ন করপোরেট গ্রুপ কৃষকের কাছ থেকে চাল মজুত করে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নামে বাজারজাত করছে। এদের বিক্রয়কর্মীরা আগামীতে চালের দাম আরও বাড়বে এমন গুজব ছড়িয়ে চাল মজুত করতে উৎসাহিতও করছে।’
চাক্তাই চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওমর আজম বলেন, ‘চালের দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে কারসাজির পাশাপাশি শুল্ক্কহার কমানোর দিকে নজর দিতে হবে। নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে পরিবহন ভাড়াও। গত ১৪ আগস্ট গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) প্রধান কার্যালয়ে চাল ব্যবসায়ী নেতা, মিল মালিক, আমদানিকারকসহ সংশ্নিষ্টদের নিয়ে আয়োজিত এক বৈঠকেও এসব বিষয়ে নজর দিতে আহ্বান জানিয়েছি আমরা।’
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন বলেন, ‘নানা ছুতায় চালের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে অসাধু সিন্ডিকেট। গরিবের মোটা চালের দামও ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। সিন্ডিকেটের কারসাজিতে চালের এমন রেকর্ড দামের পরও জড়িতদের ব্যাপারে নীরব ভূমিকা প্রশাসনের। বাজার তদারকি না থাকায় যার যেমন ইচ্ছে তেমন নীতিতেই ভোক্তার পকেট কাটছে অসাধুরা।’
এক ব্যবসায়ী নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘কারসাজির সঙ্গে চট্টগ্রামের অনেক ব্যবসায়ী ও আড়তদার জড়িত। এদের কয়েকজন এরই মধ্যে অনেক টাকা হাতিয়েও নিয়েছে। বিভিন্ন করপোরেট গ্রুপের কাছে এখন চালের বাজার জিম্মি হয়ে পড়েছে। তারা মিল মালিকদের কাছ থেকে চাহিদামতো চাল কিনে মজুত করে রাখছে। পরে ৫ থেকে ২৫ কেজি ওজনের প্যাকেটে করে চাল বিক্রি করা হচ্ছে। এতে বাজারে সংকট তৈরির কারণে দাম বেড়ে যাচ্ছে।’
ভয়েস/জেইউ।